সকল করদাতার ব্যাংক হিসাবের চার ধরণের তথ্য চেয়ে চিঠি দিল এনবিআর!

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করদাতাদের অনলাইন রিটার্নের সঙ্গে সরাসরি করদাতাদের যুক্ত ব্যাংকের তথ্য—যেমন অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স, সুদের আয় এবং উৎসে কর্তনকৃত কর—রিয়েল-টাইমে জানার সুযোগ চাইছে। কর ফাঁকি রোধ, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া সহজ করতেই এনবিআর এই পদক্ষেপ নিতে চাইছে এনবিআর। তবে ই-রিটার্নে করদাতার তথ্য অটো পূরণ বা দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা হলো ব্যাংক কোম্পানি আইন। এই আইন সংশোধনের জন্য এনবিআর থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের গ্রাহক ও ই-রিটার্ন প্রদানকারী করদাতার ব্যাংক হিসাবে পুরোপুরি প্রবেশাধিকার নয়, রিটার্নে করদাতা ব্যাংক সংক্রান্ত যে তথ্য দেয়, তা অটো নিতে চায় এনবিআর। এতে করদাতাকে কষ্ট করে ব্যাংকে যেতে হবে না। আর এনবিআরের ওই করদাতার তথ্যের সঠিকতা যাচাইয়ে বেগ পেতে হবে না।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগে চিঠি দিয়ে এনবিআরের এ পর্যালোচনার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠানো হয়েছে। এটি কর ফাঁকি ও ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম কমাতে সাহায্য করবে এবং গোপন হিসাব ও লেনদেনের তথ্য আড়াল করার সুযোগ কমিয়ে দেবে। তবে ব্যাংকাররা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এতে করদাতাদের গোপনীয় ব্যাংক তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, যা মানুষকে ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করবে।

এনবিআরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টিআইএনধারী (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরধারী) রয়েছেন। এরমধ্যে গত বছর রিটার্ন দাখিল করেছেন প্রায় ৪৫ লাখ করদাতা, যার মধ্যে অনলাইনে রিটার্ন জমা পড়েছে প্রায় ১৫ লাখ। কেবল কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, এ বছর থেকে অনলাইন রিটার্ন দাখিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবার প্রায় ১৮ কোটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। যার মধ্যে অনেক হিসাবধারীর একাধিক হিসাব রয়েছে। অন্তত ৪ কোটি হিসাবধারী ধরা হলেও, তাদের বেশিরভাগ রিটার্ন দেয় না।

অপরদিকে, মঙ্গলবার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানেএনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান অর্থ বিভাগকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা ই-রিটার্ন চালু করেছি। এই ই-রিটার্ন যাতে করদাতারা সহজে দিতে পারেন, সেজন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এখন করদাতারা ই-রিটার্ন পূরণ করতে হলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে স্টেটমেন্ট, সার্টিফিকেট আনতে হয়। আমরা বলেছি, এই স্টেটমেন্ট, সার্টিফিকেট যাতে আনতে না হয়-সেজন্য ই-রিটার্নের সঙ্গে যদি প্রত্যেকটি ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সিস্টেমের সংযোগ করতে পারি, আমরা শুধু ডাটা নিয়ে আসবো, যেটা ডাটা একজন করদাতাকে তার রিটার্নে দিতে হয়। বিশেষ করে চারটি তথ্য দিতে হয়। ৩০ জুন করদাতার ব্যালেন্স কত ছিলো, সারা বছর কত মুনাফা দেওয়া হয়েছে, কি পরিমাণ ট্যাক্স কর্তন করা হয়েছে, ব্যাংক কি পরিমাণ চার্জ করেছে। এই ডাটাগুলো যদি আমরা অটোমেটিক্যালি সিস্টেম থেকে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে আমাদের উভয়ের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আমরা দেখেছি, ব্যাংক আইনে ছোট্ট একটি বিষয় যোগ করলেই হয়। এনবিআর থেকে আমরা কোনো গ্রাহকের হিসাবে ‘একসেস’ চাই না। শুধুমাত্র দুটো সিস্টেম অটো ডাটা ফুল করবে। এটা করতে পারলে রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টে একটি ডিসিপ্লিন আসবে।’

অন্যদিকে, এনবিআরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘আমরা করদাতাদের সব তথ্য চাইছি না। আমরা শুধু সেই তথ্য চাইছি যা কর রিটার্নে ইতোমধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। সেগুলো অনলাইন রিটার্ন ব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় করার প্রস্তাব দিয়েছি, যাতে করদাতারাও একই তথ্য সমন্বিতভাবে দেখতে পারেন। এটি করদাতাদের জন্যও সুবিধাজনক হবে। বর্তমানে ব্যাংকগুলো উৎসে কর (টিডিএস) কর্তন করে, আর করদাতাদের ফাইল রিটার্নের সময় প্রত্যেক ব্যাংক থেকে আলাদা সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়। রিয়েল-টাইম অ্যাক্সেস থাকলে রিটার্ন দাখিলের সময় এই তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে চলে আসবে। এতে একাধিক ব্যাংক থেকে সনদ জোগাড়ের প্রয়োজন থাকবে না।’

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমরা শুধু তিন ধরনের তথ্য চাইছি—সুদের আয়, উৎসে কর্তনকৃত কর এবং সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের শেষ দিনে অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স। এর বাইরে কোনো লেনদেনের তথ্য চাইছি না। এজন্য বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হলে, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা সেটি বিবেচনা করবে।’

সূত্রমতে, বর্তমানে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী গ্রাহকের ব্যাংকিং তথ্য গোপন রাখা হয়। এর ফলে এনবিআর বা অন্য কোনো সংস্থা সরাসরি কিংবা রিয়েল-টাইমে আমানতকারীর ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত তথ্যের অ্যাক্সেস পায় না। বর্তমানে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার তথ্য প্রয়োজন হলে—ব্যাংকগুলো কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাওয়ার পরেই তা সরবরাহ করে থাকে। তবে প্রস্তাবিত নতুন রিয়েল-টাইম অ্যাক্সেস ব্যবস্থা চালু হলে কর কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট করদাতার এসব তথ্য সরাসরি সংগ্রহ করতে পারবেন।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমি এখনও এনবিআরের এমন কোনো চিঠি পাইনি, তবে এনিয়ে আলোচনা চলছে। বর্তমানে আমরা (করদাতারা) রিটার্ন দাখিলের সময় ব্যাংক স্টেটমেন্ট যুক্ত করি। এনবিআরের প্রস্তাব হচ্ছে, এসব স্টেটমেন্ট সরাসরি ব্যাংকিং সিস্টেম থেকেই সরবরাহ করা যেতে পারে, যাতে অনলাইন রিটার্ন সিস্টেমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব তথ্য যুক্ত হয়। তবে করদাতাদের সব তথ্য নয়—শুধুমাত্র যেসব তথ্য রিটার্নে সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক, সেগুলোই চাওয়া হয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *