দেশের আর্থিক খাতের পরিসর ছোট—এই নিয়ে অর্থনীতিবিদদের ওজর-আপত্তি অনেক দিনের। আর্থিক খাত বলতে আছে কেবল ব্যাংক। শেয়ারবাজারের অবস্থা এতটা করুণ, অনেক মানুষ সেখানে যাওয়ার সাহসই পান না। বন্ডের বাজার মূলত সরকারি। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র। বেসরকারি বন্ডের পরিসর আরও ছোট।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, সঞ্চয়পত্র ট্রেডেবল বা লেনদেনযোগ্য করা দরকার। সন্দেহ নেই, আর্থিক খাতের পরিসর বড় করার লক্ষ্যে এ কথা বলেছেন তিনি।
সঞ্চয়পত্রও একধরনের বন্ড। বন্ড হলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণের প্রতিশ্রুতিপত্র; কিন্তু এই শর্তের নিরাপত্তার ধরন বিভিন্ন। অনুন্নত দেশে যেখানে বন্ড বাজার চালু নয় কিংবা এখনো অতটা বিকশিত হয়নি, সেখানে মূলত সরকার বন্ড ইস্যু করে থাকে। তাকে সরকারি বন্ড বলে। যুক্তরাষ্ট্রে একে বলে ট্রেজারি বন্ড। সরকারি বন্ডের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি বলে এতে প্রদেয় সুদহার বা কুপন রেট সাধারণত কম হয়। কিন্তু আমাদের মতো দেশে তা উল্টো—সঞ্চয়পত্র বা ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদহার ব্যাংকের সুদহারের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয় প্রতিবছর। ফলে ব্যাংক আমানতের পরিমাণ কমে যায়; টান পড়ে বিনিয়োগযোগ্য অর্থে।
সেকেন্ডারি মার্কেট কী
বিষয়টি হলো কোনো কোম্পানি যখন প্রথম অবস্থায় বন্ড বিক্রি করে কিংবা প্রাথমিক গণবিক্রয় বা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং বা সংক্ষেপে আইপিওর মাধ্যমে বাজারে একেবারে প্রথম অবস্থায় শেয়ার ছাড়ে, তখন সেগুলো প্রাথমিক বাজারের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই শেয়ার বা বন্ডগুলোর প্রাথমিক মালিকেরা যদি টাকার প্রয়োজনে বিক্রি করে দেন, তখন তা দ্বিতীয় পর্যায়ের বাজার বা সেকেন্ডারি মার্কেটে করতে হয়। প্রাথমিক বাজারে কেনাবেচা একবারই হয়; কিন্তু দ্বিতীয় বাজারে কেনাবেচা কতবার হবে, তার সীমারেখা নেই।
এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রের সেকেন্ডারি মার্কেট থাকলে কী হতে পারে, তা দেখে নেওয়া যাক:
ইতিবাচক দিক
সঞ্চয়পত্রের সেকেন্ডারি বাজার চালু হলে আর্থিক খাতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে। প্রথমত, বাজারে তারল্য বাড়বে। কেউ জরুরি প্রয়োজনে সহজেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি করতে পারবেন, ক্রেতারা চাইলে সরাসরি বাজার থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। এতে লেনদেন আরও সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগকারীর আস্থা ও আগ্রহ বাড়বে। বর্তমানে অনেকেই সঞ্চয়পত্র কেনার পর দীর্ঘদিন টাকা আটকে থাকার ভয়ে পিছিয়ে যান; কিন্তু সেকেন্ডারি বাজার থাকলে প্রয়োজনে তা বিক্রি করা সম্ভব। ফলে মানুষের স্বাধীনতা বাড়বে।
তৃতীয়ত, সরকারের দায় ব্যবস্থাপনাও সহজ হবে। লেনদেন বাজারে হলে সরকারকে মেয়াদপূর্তির আগেই সরাসরি অর্থ ফেরত দেওয়ার চাপ কিছুটা কমবে। একই সঙ্গে ব্যাংকঋণের সুদ ও সঞ্চয়পত্রের সুদের মধ্যে ভারসাম্য আনার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হতে পারে।
সবশেষে বাজারে লেনদেনের ধারা থেকেই বোঝা যাবে, সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্রের ওপর কতটা আস্থা রাখছেন। এটি সরকারের আর্থিক নীতি প্রণয়নেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
নেতিবাচক দিক ও ঝুঁকি
সঞ্চয়পত্রের সেকেন্ডারি বাজার চালু হলে যেমন সম্ভাবনা আছে, তেমনি কিছু ঝুঁকিও থেকে যাবে। সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো সুদের হার বিকৃতি। যদি বাজারে সঞ্চয়পত্র ছাড়ে বিক্রি হয়, তাহলে কার্যকর সুদের হার সরকারের ঘোষিত হারের সঙ্গে মিলবে না। এতে নীতিনির্ধারণে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
আরেকটি আশঙ্কা হলো অতিরিক্ত জল্পনাকল্পনা। কিছু লোক হয়তো কম দামে সঞ্চয়পত্র কিনে বেশি দামে বিক্রি করে ফাটকাবাজি শুরু করবে। এতে মূল উদ্দেশ্য—সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে সুরক্ষা দেওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেকেন্ডারি বাজারে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সঞ্চয়পত্রে বাজারসুবিধা পাওয়া গেলে মানুষ বেশি করে এতে বিনিয়োগ করবেন। ফলে ব্যাংক আমানত ও বেসরকারি বন্ড বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এতে ব্যাংকের তারল্যসংকট দেখা দেওয়ার ঝুঁকিও থেকে যাবে।
প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকেও সঞ্চয়পত্রের সেকেন্ডারি বাজার চালু করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। নিরাপদ ও কার্যকর লেনদেনের জন্য স্বচ্ছ কাঠামো ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য।
কী বলছেন বিশ্লেষকেরা
সঞ্চয়পত্রের এই লেনদেনের পরামর্শের বিষয়টি স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ধরা যাক কেউ পাঁচ বছরের জন্য সঞ্চয়পত্র কেনেন, কিন্তু চার বছরের মাথায় তাঁর তারল্যসংকট হলো, তখন তিনি কী করবেন। এ সমস্যার সমাধান হলো লেনদেন যোগ্যতা। অর্থাৎ তিনি সেকেন্ডারি বাজারে কোনো গ্রাহকের সঙ্গে দর-কষাকষি করে সঞ্চয়পত্রটি বিক্রি করে দিতে পারেন। যিনি কিনবেন, তিনিও জানেন—এক বছর পর মেয়াদপূর্তিতে তিনি সেই সরকারের প্রতিশ্রুত টাকা পাবেন। এটি একধরনের উদ্ভাবন।
কিন্তু আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে যাঁরা সঞ্চয়পত্র কেনেন, তাঁরা মূলত এটিকে সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে দেখেন। এটি বাংলাদেশের সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম হাতিয়ার। অনেকটা সোনার মতো। সোনার দাম বাড়লেও যেমন মানুষ তা বিক্রি করতে হুমরি খেয়ে পড়ে না, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে চায়, সঞ্চয়পত্রও অনেকটা তেমন। গ্রামের শিক্ষক বা স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীরা অবসরের পর বাজার খরচ মেটাতে এই সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এমনকি তাঁরা উত্তরাধিকার হিসেবেও এই সঞ্চয়পত্র রেখে যান। ফলে সঞ্চয়পত্র একেবারে ঠিক বন্ডের মতো নয়। এই বাস্তবতায় দেশে সঞ্চয়পত্রের সেকেন্ডারি বাজার চালু হলেই যে তেমন জনপ্রিয় হবে, সে বিষয়ে আশাবাদী নন বিরূপাক্ষ পাল।
মানুষ সঞ্চয় ভাঙছে
দীর্ঘদিন ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির জেরে মানুষ সঞ্চয় ভাঙতে শুরু করেছে। তিন অর্থবছর ধরে সঞ্চয়পত্রে ঋণাত্মক বিক্রি দেখা গেছে। অর্থাৎ মেয়াদোত্তীর্ণ সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ নতুন বিনিয়োগের চেয়ে বেশি ছিল। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সে কারণেও সঞ্চয়পত্রকে লেনদেনযোগ্য করার কথা ভাবতে পারেন গভর্নর। বাস্তবতা হলো, দেশে বন্ডের বাজার এমনিতে অতটা শক্তিশালী নয়। তার সঙ্গে যাঁরা সঞ্চয়পত্র কেনেন, তাঁরা কীভাবে এই সেকেন্ডারি বাজারে প্রবেশাধিকার পাবেন, সেই প্রশ্ন থেকে যায়।
বন্ড বাজারের দুরবস্থা
বন্ড বাজার যেখানে উন্নয়নশীল অর্থনীতির প্রাণের মতো, সেখানে বাংলাদেশে বন্ড বাজারের অবস্থা নাজুক। বন্ড সাধারণত সরকারের ব্যয় নির্বাহে অর্থ জোগায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে মূলধনের জোগান নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের বন্ড বাজার—সরকারি সিকিউরিটি ও করপোরেট বন্ড মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১২ শতাংশের কম। এর মধ্যে সরকারি সিকিউরিটি সিংহভাগ। অন্যদিকে মালয়েশিয়ায় এ হার ১২৫ শতাংশ, চীনে ১০৭ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৫০ শতাংশ। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের বন্ড বাজারও সমৃদ্ধ।