রাজধানীর একটি সরকারি অফিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান। গত পাঁচ বছর ধরে ম্যানুয়াল রিটার্ন দাখিল করেন। প্রতি বছর রিটার্ন তৈরিতে তিনি একজন আয়কর পেশাজীবীর (আইটিপি) সহায়তা নেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবার সরকারি চাকরিজীবীদের অনলাইনে রিটার্ন (ই-রিটার্ন) দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। নিজের রিটার্ন নিজে পূরণ করার প্রত্যয়ে নিজে ই-রিটার্ন নিবন্ধন করলেন। অনলাইনে রিটার্ন পূরণও করলেন। সম্পদের অংশ ও সম্মানীর ক্ষেত্রে কিছু আয় উল্লেখ না করেই রিটার্ন সাবমিট করে সনদও নিয়েছেন। প্রথমবার কারও সহযোগিতা ছাড়াই রিটার্ন দিতে পেরে খুশি এই কর্মকর্তা। তবে ‘সম্পদ বিবরণী’ তৈরি করতে গিয়ে তিনি দেখলেন রিটার্নে ভুলে সম্পদ উল্লেখ করা হয়নি। ই-রিটার্নে ভুল সংশোধনের সুযোগও নেই। এনবিআর ‘বাধ্যতামূলক’ করায় বিপদে পড়লেন তিনি।
একই সমস্যায় পড়লেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। তিনি সম্পদ অংশ ও কয়েক ধরনের আয়ের অংশ রিটার্নে উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন। রিটার্ন সাবমিট করার পর মনে হলো। কিন্তু অনলাইনে সংশোধনের কোনো সুযোগ না রাখায় বেকায়দায় পড়েন তিনি। শুধু এই দুই কর্মকর্তাই নন যাদের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাদের অনেকেই ভুল করতেন। এছাড়া যাদের বাধ্যতামূলক করা হয়নি তাদের অনেকেই অনলাইনে রিটার্ন পূরণে ভুল করেছেন। তারা বলছেন, ম্যানুয়ালি রিটার্ন দাখিল করলে রিটার্নে ভুল হলে আইন অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অনলাইনে রিটার্নে ভুল হলে সংশোধনের সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে ভুল হলে করদাতা পরবর্তী সময়ে হয়রানির শিকার হতে পারেন।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, করদাতাদের ভয়ের কারণ নেই। যাদের বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা অনলাইনে ভুল করে রিটার্ন সাবমিট করে দিয়েছেন, কেবলমাত্র তারা ম্যানুয়ালি রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। তবে আগামী বছর থেকে এই সুযোগ থাকবে না। আর ই-রিটার্নে সংশোধনের অপশন রাখার বিষয় এনবিআর আলোচনা করছে। এক্ষেত্রে একবার সুযোগ দেয়া হতে পারে। করদাতা সংশোধন করলেও সার্কেল কর্মকর্তার অনুমাদন ছাড়া সাবমিট হবে না।
যাদের বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা অনলাইনে ভুল করে রিটার্ন সাবমিট করে দিয়েছেন, কেবলমাত্র তারা ম্যানুয়ালি রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
এনবিআর সূত্রমতে, কর অফিসে ম্যানুয়ালি রিটার্ন দাখিল, প্রাপ্তি স্বীকার ও সনদ নেয়ার ক্ষেত্রে করদাতাদের হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এই হয়রানি থেকে করদাতাদের স্বস্তি দিতে অনলাইন রিটার্ন বা ই-রিটার্ন পদ্ধতি চালু করে এনবিআর। মূলত নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী আয়কর বিভাগকে অটোমেশন বিশেষ করে ‘ইলেট্রনিক কর ব্যবস্থাপনা’ চালুর বিষয়ে ধারা যুক্ত করা হয়েছে। সে অনুযায়ী করদাতাদের স্বস্তি দিতে সম্প্রতি নতুন উদ্যোমে ই-রিটার্ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ই-রিটার্ন পদ্ধতি প্রতিনিয়ত করদাতাদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। আরও জনপ্রিয় করতে চার শ্রেণির করদাতাদের অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। চলতি বছরের ২২ অক্টোবর এনবিআর মো. আবদুর রহমান খান সই করা ‘স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে রিটার্ন দাখিলসংক্রান্ত বিশেষ আদেশ’ জারি করা হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, এই আদেশ জারির ফলে করদাতাদের একটি বড় অংশ অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করবে। যার মধ্য দিয়ে ই-রিটার্ন আরও জনপ্রিয় হবে। ভবিষ্যতে আরও কয়েক শ্রেণির করদাতাদের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হবে।
আদেশে বলা হয়েছে, আয়কর আইন, ২০২৩ এর ধারা ৩২৮ এর উপধারা (৪) এর ক্ষমতাবলে এনবিআর এই বিশেষ আদেশ দ্বারা চার শ্রেণির স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাদের ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করছে। চার শ্রেণির মধ্যে রয়েছে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে অবস্থিত আয়কর সার্কেলগুলোর অধিক্ষেত্রভুক্ত সব সরকারি কর্মচারী। দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সব মোবাইল অপারেটর বা মোবাইল টেলিকম সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়া ছয়টি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনলাইন রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোম্পানিগুলো হলো ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড, বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড ও নেসলে বাংলাদেশ পিএলসি।
এনবিআর চেয়ারম্যান একাধিকবার বলছেন, যে চার শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তারা প্রযুক্তি ও শিক্ষায় অন্য খাতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাদের সব সময় প্রযুক্তির সংস্পর্শে থাকতে হয়। ফলে এই চার শ্রেণির অনলাইনে রিটার্ন পূরণ ও জমা দেয়া সহজ। সেজন্য প্রাথমিকভাবে এই চার শ্রেণির করদাতার ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সব শ্রেণির করদাতার জন্য ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হবে। তিনি আরও বলেছেন, যাদের ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাদের ম্যানুয়াল রিটার্ন নেয়া হবে না। ই-রিটার্ন এত সহজ সিস্টেম যে, কোনো করদাতা চাইলে অল্প অল্প করে, যত দিন ইচ্ছে সময় নিয়ে পূরণ করতে পারেন। এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। রিটার্নে দাখিলের জন্য অ্যাপ তৈরির কথাও বলেছেন তিনি। যাতে আরও সহজে রিটার্ন দাখিল করা যায়।
অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিল করা একাধিক করদাতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমবার ই-রিটার্ন দাখিল করার ক্ষেত্রে বেশির ভাগই আয়কর আইনজীবী বা আয়কর পেশাজীবীর সহযোগিতা নেননি। কেউ কেউ সহযোগিতা নিলেও নিজের রিটার্ন নিজে পূরণ করে সাবমিট করেছেন। তবে অনেকেই অনলাইন রিটার্নে ভুল রয়ে গেছে। তাদের মতে, সিস্টেম খুবই চমৎকার। এনবিআর প্রতিনিয়ত সিস্টেম আপডেট করছে। ম্যানুয়াল রিটার্ন দাখিলে ভুল হলে সংশোধনী দেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু অনলাইনে ভুল সংশোধনের সুযোগ না রেখে বাধ্যতামূলক করায় অনেকেই বেকায়দায় পড়েছেন। তারা বলছেন, ম্যানুয়ালি রিটার্নের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেয়া লাগত। অনলাইনে দেয়া লাগছে না। সেক্ষেত্রে ভুল হলে ভবিষ্যতে করদাতা হয়রানির শিকার হতে পারেন। সেজন্য একবারের জন্য হলেও অনলাইনে ভুল সংশোধনের অপশন রাখা উচিত বলে মনে করেন করদাতারা।
প্রথমবার ই-রিটার্ন দাখিল করার ক্ষেত্রে বেশির ভাগই আয়কর আইনজীবী বা আয়কর পেশাজীবীর সহযোগিতা নেননি। কেউ কেউ সহযোগিতা নিলেও নিজের রিটার্ন নিজে পূরণ করে সাবমিট করেছেন।
এই বিষয়ে আয়কর বিভাগের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ই-রিটার্নে ভুল হলে কর অফিসে ম্যানুয়াল রিটার্ন দেয়া যাবে। যাদের বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তারা এ বছরের জন্য এই সুযোগ পাবেন। তবে অনলাইনে ভুল হলে কেবল ম্যানুয়াল রিটার্ন দিতে পারবেন। যাদের অনলাইনে ভুল হয়নি, তাদের ম্যানুয়াল রিটার্ন দেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, আমরা কমিশনারদের মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছি যে, যাদের বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাদের ই-রিটার্ন দাখিলে ভুল হলে ম্যানুয়াল রিটার্ন নিতে।
ই-রিটার্নে ভুল হলে কর অফিসে ম্যানুয়াল রিটার্ন দেয়া যাবে। যাদের বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তারা এ বছরের জন্য এই সুযোগ পাবেন।
আয়কর আইন অনুযায়ী, কোনো করদাতা রিটার্ন দাখিল করলে যদি রিটার্নে ভুল থাকে, তাহলে ১৮০ দিনের মধ্যে সংশোধিত রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। কিন্তু ই-রিটার্নে ভুল সংশোধনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এনবিআর এই নিয়ে কাজ করছে কি নাÑএমন প্রশ্নে কর বিভাগের এই জ্যেষ্ঠ সদস্য বলেন, বেশ কিছু কারণে ই-রিটার্নে সংশোধনের অপশন রাখা হয়নি। অপশন রাখা হলে দেখা যেত একজন করদাতা বা আইনজীবী বারবার প্রবেশ করে বারবার সংশোধন করতেন। যদি অডিটে পড়ে, তাহলে আবার প্রবেশ করে সংশোধন করে দেবেন। এতে করে তথ্য ম্যানুপুলেট করা ও করফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকত। তবে সংশোধনের অপশন রাখার চিন্তা করছে এনবিআর। এখনও আলোচনা পর্যায়ে আছে। সামনে হয়ত সিদ্ধান্ত হবেন।
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন করদাতা একবার প্রবেশ করে সংশোধন করে সাবমিট করবেন। তবে সংশ্লিষ্ট সার্কেল কর্মকর্তার অ্যাপ্রুভ ছাড়া সাবমিট হবে না। ওই কর্মকর্তা দেখে-শুনে অ্যাপ্রুভ করবেন। এতে এই করদাতা কী ধরনের তথ্য সংশোধন করলেন, কী কারণে করলেন তা সার্কেল কর্মকর্তার নলেজে থাকবেন। কোনো করদাতা চাইলেই ম্যানুপুলেট করতে পারবেন না। এনবিআরের বুধবারের হিসাব অনুযায়ী, ই-টিআইএন নিবন্ধন সংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ ৬০ হাজার ২২০। আর অনলাইনে ই-রিটার্ন দাখিলের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ করদাতা। যার মধ্যে ৮ লাখ ৯ হাজার ২৫৪ জন করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন।