‘রিডিউস ট্যাক্স রেট’ (কম করের সুবিধা) এর সুযোগ নিয়ে মৎস্য খাতের আয় দেখিয়ে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুবিধা আর থাকবে না
দেশে ‘রিডিউস ট্যাক্স রেট’ (কম করের সুবিধা) এর সুযোগ নিয়ে মৎস্য খাতের আয় দেখিয়ে কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুবিধা বন্ধ করতে উদ্যোগ নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বর্তমানে ব্যক্তির (ইনডিভিজুয়াল) রেগুলার ট্যাক্স রেট সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। কিন্তু মৎস্য খাতের আয় দেখালে সর্বোচ্চ কর হার মাত্র ১৫ শতাংশ।
ফলে এই সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী নিজের বা পরিবরের সদস্যদের নামে অবৈধ পথে উপার্জিত বিস্তর পরিমাণ অর্থ বছরের পর বছর ধরে সাদা করে আসছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তিনি বলেন, “এ সুবিধা একেবারে বাতিল না করে, প্রকৃত মৎস্য চাষীদের কীভাবে কিছুটা সুবিধা দেওয়া যায়, সে চেষ্টা থাকবে। এ বিষয়ে আদেশ জারির লক্ষ্যে কাজ চলছে। শিগগিরই আদেশ জারি হতে পারে।”
অবশ্য আদেশ জারি হলেও তা পরবর্তী, অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আয়ের ওপর কার্যকর হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
পাশাপাশি, মৎস্য খাতের বাইরে বিভিন্ন এসআরও’র মাধ্যমে কিছু গোষ্ঠী বা কোম্পানিকে দেওয়া আরো ৫টি আদেশ বাতিল হতে পারে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা
এনবিআরের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক ইনকাম ট্যাক্স পলিসির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম বলেন, “মৎস্য খাতের আয় দেখানো মূলত কালো টাকা সাদা করার একটি রাস্তা। এটি বাতিল করাই উত্তম।”
তিনি বলেন, “এর মাধ্যমে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা উপকৃত হয়েছেন বলে আমার জানা নেই। মূলত এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী বা অন্যান্য লোকজন অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ কম ট্যাক্স দিয়ে সাদা করার জন্য এই পন্থা অবলম্বন করতেন।”
“এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাতো, অন্যদিকে অবৈধ আয় উৎসাহিত হতো,” বলেন তিনি।
অবশ্য এই সুবিধা বাতিল করার ক্ষেত্রে প্রকৃত মৎসজীবীদের কীভাবে সুবিধা দেওয়া যায়, তা বিবেচনায় রাখা উচিত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা একেবারেই ক্ষুদ্র মৎস্য চাষী, তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে চাষ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় এই সুবিধার আওতায় রাখা যেতে পারে।”
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মৎস্য খাতে আয় হলে প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত। এর পরবর্তী ১০ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ১০ লাখ টাকা আয়ের ওপর ১০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ ট্যাক্স রয়েছে। অর্থাৎ, ৩০ লাখ টাকার উপরে আয় হলে ১৫ শতাংশ আয়কর দিতে হয়— যেখানে একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাকে দিতে হয় এর দ্বিগুণ।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মৎস্য খাতের আয়ের ওপর ট্যাক্স রেট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া যায়নি। ফলে পিছিয়ে আসতে হয় এনবিআরকে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, “কম করের এই সুবিধা দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ উপায়ে অর্জিত টাকা বৈধ করার একটি পথ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল। এই সুবিধা বাতিল করার পদক্ষেপকে আমি স্বাগত জানাই।”
একইসঙ্গে তিনি ‘মাথাব্যথা হলে, তা সমাধানের জন্য মাথা কেটে ফেলা’ এর মতো চরম পদক্ষেপের ব্যাপারে সতর্কও করেছেন। তিনি মৎস্য খাতের প্রকৃত ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে, তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন।
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
অবশ্য সরকারের এমন উদ্যোগের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে কোনো কোনো ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান টিবিএসকে বলেন, “যারা এই সুযোগের অপব্যবহার করছে, তাদের আইডেন্টিফাই করে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু যারা প্রকৃত ব্যবসায়ী, তাদের জন্য এ সুবিধা বাতিল করা যৌক্তিক হবে না।”
তিনি বলেন, “মৎস্য খাত দেশের একটি চাহিদাসম্পন্ন খাত। এরসঙ্গে দেশের পুষ্টির চাহিদার বিষয়টিও জড়িত। ঢালাওভাবে রিডিউসড ট্যাক্স সুবিধা বাতিল করে ট্যাক্স বাড়লে, এই খাতের প্রবৃদ্ধিতে নেয়িবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”
দেশের অনেক স্টার্টআপ মৎস্য বা পশুপালনের মাধ্যমে শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকারের উচিত হবে, এমন কৌশল তৈরি করা— যাতে এর অপব্যবহার কেউ করতে না পারে।”
মৎস্য খাত থেকে কী পরিমাণ আয় দেখানো হয়েছে, তার পরিসংখ্যান এনবিআরের কাছে পাওয়া যায়নি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো কোনো ব্যক্তি কোটি কোটি, এমনকি শত কোটি টাকাও এই খাতের আয় হিসেবে দেখিয়েছেন।