কৃষি, মৎস্য ও পোলট্রি খাতে হ্রাসকৃত করহার বাতিল হচ্ছে!

কৃষি, মৎস্য ও পোলট্রি খাতে হ্রাসকৃত করহার বহাল থাকছে না। আগামী বাজেটে এ-সংক্রান্ত তিনটি সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) বাতিল করা হচ্ছে। এসব খাতে সাধারণ করহার প্রযোজ্য হবে।

কৃষি, মৎস্য ও পোলট্রি খাতে হ্রাসকৃত করহার বহাল থাকছে না। আগামী বাজেটে এ-সংক্রান্ত তিনটি সংবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক আদেশ (এসআরও) বাতিল করা হচ্ছে। এসব খাতে সাধারণ করহার প্রযোজ্য হবে। কম করহারের সুবিধার অপব্যবহার ও কর অব্যাহতি থেকে সরে আসতে এসআরওগুলো বাতিল করা হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকেও কর অব্যাহতি থেকে সরে আসার চাপ রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী বাজেটে কৃষি, মৎস্য ও পোলট্রি খাতের এ করছাড় সুবিধা বাতিল করে এ আয়কে সাধারণ করহারে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্রান্তিক মৎস্যচাষীদের সুরক্ষা দিতে ৫ লাখ বা সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখার প্রস্তাব থাকছে বলেও জানান তারা।

এনবিআরের ‍ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এসআরও তিনটি এবার ডিলিট করে দেয়া হবে। এটাই চূড়ান্ত। এগুলো আর রাখা হবে না। এগুলোর ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে।’

তবে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এসব খাতে ২০১৫ সালে করারোপ শুরু হয়েছে। এর আগে সম্পূর্ণ করমুক্ত ছিল। এবারে কী করব তা এখনো ঠিক হয়নি।’ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর কর ৩ শতাংশ নির্ধারণ করে হঠাৎ এক মাস পর আগস্টে শূন্য শতাংশ হয়ে যাওয়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিদ্ধান্তের আগেই আমি ২০১৫ সালের এপ্রিলে উপসচিব পদে যোগ দিয়েছি। এ বিষয়ে জানি না।’

এনবিআর কর্মকর্তাদের দাবি, মূলত এসব খাত বিকাশের জন্য কম করহারের এ সুবিধা দেয়া হয়েছিল। যদিও এ সুবিধার অপব্যবহারই হয়েছে বেশি। কর কম হওয়ায় মৎস্য খামার কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের বড় খাত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কর ফাঁকি বা কর এড়ানোর কৌশল হিসেবে মৎস্য খাতকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে মৎস্য চাষ থেকে বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি আয় দেখিয়েছেন তারা। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামায় দেখা যায়, অর্ধশতাধিক ‘মাছচাষী’ রাজনীতিবিদ প্রার্থী হয়েছেন। তারা তাদের হলফনামায় অস্বাভাবিক পরিমাণ আয় দেখিয়েছেন মৎস্য খাত থেকে। এ তালিকায় সাবেক মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতাসীন দলের আলোচিত নেতারাও ছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী আফছারুল আমীন, আবদুল মান্নান খান, সাবেক এমপি মোশারফ হোসেন, নবম জাতীয় সংসদের হুইপ নূরে আলম চৌধুরী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রমুখ। বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি সর্বজনীন স্বনির্ধারিত পদ্ধতিতে আয়কর বিবরণী জমা দেয়ায় তাদের নথি নিরীক্ষায়ও আনা হয়নি।

খাল, বিল ও পুকুরের মাছ পানির নিচে থাকায় সরজমিনে গিয়ে এনবিআরের কর্মকর্তাদের পক্ষে ওই খামারের আয়-ব্যয় প্রাক্কলন করা সম্ভব নয়। কী পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে তাও জানা সম্ভব হয় না। এ সুযোগই নেন ‘মাছচাষী’ রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা। নিজেদের যে পরিমাণ সম্পদের উৎস বৈধ নয়, আয়কর বিবরণীতে সেই টাকা মৎস্য আয় হিসেবে দেখিয়ে দেন তারা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকেও একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য ২০২৪ সালে একটি গাইডলাইন তৈরি করে দুদক। সেখানেও মৎস্য চাষ ও কৃষি থেকে আয়ের উৎস খতিয়ে দেখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

মৎস্য খামারের আড়ালে সম্পদ গোপন করেছেন খোদ এক রাজস্ব কর্মকর্তারই স্ত্রী। তিনি ১ কোটি ৪২ লাখ ২২ হাজার ৭৪৫ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেছেন। এ অভিযোগে ২০২২ সালের মার্চে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এতে তাসনুভা চৌধুরী ও তার স্বামী পানগাঁও শুল্ক ও গোয়েন্দা সার্কেলের রাজস্ব কর্মকর্তা আবদুল মান্নান মজুমদারকে আসামি করা হয়।

সম্পদ গোপন ও কর ফাঁকি দিতে ভুয়া দলিল তৈরি করে মাছের খামার থেকে ২১৫ কোটি টাকা আয় দেখিয়েছেন আলোচিত ব্যবসায়ী নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। তিনি ২০১৯-২০ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে নিজেকে মাছের খামারি বলে পরিচয় দেন।

দুদকের সাবেক পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ সুবিধাগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিজীবীরাই নেন। কিন্তু দুদকের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। দুদক এসব আয়ের ক্ষেত্রে এভিডেন্সকে প্রাধান্য দেয়। দুদক আয়ের উৎস খোঁজে। সংশ্লিষ্টরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এভিডেন্স সরবরাহ করতে পারেন না। দুদকে এ ধরনের অসংখ্য অনুসন্ধান শেষে মামলা দায়ের ও আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়েছে।’

পুকুর বা খাল-বিল থেকে মাছ তুলে তা বিক্রির সময় পাইকারদের কোনো রসিদ দেয়ার রেওয়াজ নেই। মাছ বিক্রির কোনো দালিলিক প্রমাণও থাকে না। তাই বছর শেষে মৎস্য খাত থেকে আয়ের কোনো কাগজপত্রও দাখিল করতে হয় না। আয়কর বিবরণীতে যে আয় দেখানো হয়, তা-ই বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে বাধ্য হন মাঠপর্যায়ের কর কর্মকর্তারা।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত মৎস্য খাতের আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত ছিল। ২০০৮ সালের জুলাই থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত বার্ষিক দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত রাখা হয়। এর বেশি আয় হলে কমপক্ষে ১০ শতাংশ সরকারি বন্ড বা সিকিউরিটিজে বিনিয়োগে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। এরপর ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ৫ শতাংশ হারে করারোপ করা হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে এ করহার ৩ শতাংশে নামিয়ে দেয়া হয়। মৎস্য খাত ছাড়া অন্য খাত থেকে আয় দেখালে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর আরোপ হয়। এর ফলে মৎস্য চাষই কালো টাকা সাদা করার বড় ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৩ শতাংশ, পরবর্তী ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১০ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করেছিলেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। অথচ এর এক মাস পরই (২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট) প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর শূন্য, পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৫ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ কর নির্ধারণ করেন। ২০২২ সালের ১ জুন থেকে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমও সে ধারা অব্যাহত রাখেন। তিনি প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর শূন্য, পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১০ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করেন, যা এখনো চলমান।

দানাদার পোলট্রি ফিড উৎপাদন, গবাদিপশু, চিংড়ি ও মাছের দানাদার খাদ্য উৎপাদন, বীজ উৎপাদন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বীজ বিপণন, গবাদিপশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, উদ্যান খামার প্রকল্প, তুঁত গাছের চাষ, মৌমাছি চাষ প্রকল্প, রেশম গুটি পোকা পালনের খামার, মাশরুম উৎপাদন খামার এবং ফুল ও লতাপাতার চাষ থেকে অর্জিত আয়ের ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে কর আরোপ করা হয়। তখন প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৩ শতাংশ, পরবর্তী ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১০ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়। হঠাৎ পরের মাসে প্রথম ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ৩ শতাংশ থেকে কমে একেবারে শূন্য, পরবর্তী ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ওপর ১০ শতাংশ থেকে সরে এসে পরবর্তী ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫ শতাংশ ও অবশিষ্ট আয়ের ওপর ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ কর নির্ধারণ করা হয়। ওই বছর শুধু হাঁস-মুরগির খামার, হাঁস-মুরগি, চিংড়ি ও মাছের হ্যাচারি এবং মাছ চাষের কথা উল্লেখ করা হয়। পরে ২০২২ সালের ১ জুন থেকে আরো একটি স্ল্যাব বাড়ানো হয়, যা এখনো চলমান।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ দেশে কালো টাকা আয় করা সহজ বিধায় বিগত দিনে অনেকে হয়তো সে সুবিধা নিয়েছেন। তাছাড়া কালো টাকা সাদা করার বৈধ সুবিধা তো বিগত দিনে ছিলই। কাজেই সরকারের নীতিই যেখানে কালো টাকা আয়ের ও তা বৈধ করার সুযোগ করে দিয়েছে সেখানে সে সুযোগ ওইসব টাকার মালিকরা নেবে এটাই স্বাভাবিক। এজন্য ওইসব খাতে কর সুবিধা দেয়া কোনো অন্যায় হয়নি। এসব খাত বিকাশের জন্য কর অব্যাহতির আবশ্যকতা অবশ্যই ছিল বা আছে। রেগুলেটরি সংস্থা, গবেষণা সংস্থা, মিডিয়ার দায়িত্ব ছিল এ সুবিধা ব্যবাহার করে যাতে সংশ্লিষ্ট খাতগুলো বিকশিত হয়, সেটি নজরদারি করা। এখন যদি অভিযোগ করা হয়, ওই কর অব্যাহতি সুবিধায় ওইসব খাত বিকশিত না হয়ে ওই সুবিধার আবরণে শুধু কালো টাকা সাদা হয়েছে, তাহলে এর দায় অব্যাহতির নয়। যাদের তা দেখার দায়িত্ব ছিল তাদের। তাছাড়া এখন অব্যাহতি রহিত করলে এসব খাত থেকে খুব রাজস্ব আসবে তাও কিন্তু নয়।’

Source: বণিক বার্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *