আগামী অর্থ আইনে আয়কর অডিটের বিধান সংশোধনের উদ্যোগ

অনেক সাধারণ করদাতাও দাখিলপত্র অডিটের নামে হয়রানির অভিযোগ করেন। কর ফাইল অডিট কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতার অতি প্রয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। আয়কর ফাইল যদি কোনো কারণে অডিটের জন্য নির্বাচিত হয়, সেই করদাতাকে ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, কিছু না কিছু কর ফাঁকি খুঁজে পেতে বের করবেনই কর কর্মকর্তা। এতে অনেক সময় ঘুষ লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

করদাতা ও অডিটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিস্তর আপত্তির পর আগামী অর্থ আইনে আয়কর অডিটের বিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরইমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধতনদের সম্মতিও মিলেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক সভায়ও দাবি করা হয়, আয়কর আইন, ২০২৩ এর ১৮২ ধারায় বর্ণিত বিধানাবলী বাস্তবসম্মত না হওয়ায় অডিট মামলা নিষ্পত্তির হার অত্যন্ত হতাশাজনক। কাজেই ওই বিধানাবলীর যথাযথ প্রয়োগ ও পরিপালন সংক্রান্ত বিদ্যমান সমস্যা এবং সংস্কারের আবশ্যকতা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে এ বিধানাবলী সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাব ২৬ জানুয়ারির মধ্যে লিখিত আকারে পাঠানোর নির্দেশনাও দেয়া হয়। সভায় কর অঞ্চলগুলোর সংশ্লিষ্টরা তাদের মত তুলে ধরেন। সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) মো. আলমগীর হোসেন গত ৮ জানুয়ারি অুনষ্ঠিত ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন।

সভায় সদস্য (কর নীতি) বলেন, বিদ্যমান আইনের প্রায়োগিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে আগামী অর্থ আইনে তা সংশোধনের প্রস্তাব করা হবে। সে পর্যন্ত সম্ভাব্য আইনী জটিলতা পরিহার করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইনের বিধানের আলোকে অডিট মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিদ্যমান আইনে প্রদত্ত সময়সীমা বর্ধিত করা এবং কর্মকর্তা সংকটের বিষয়টি এনবিআর সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, এ বিষয়ে কাজ চলছে, এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি।১৮২ ধারায় বর্ণিত বিধানাবলী সংস্কার সংক্রান্ত কমিটির একটি সভা আজ রোববার (২৬ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হবে এনবিআরে।

অনেক সাধারণ করদাতাও দাখিলপত্র অডিটের নামে হয়রানির অভিযোগ করেন। কর ফাইল অডিট কর কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতার অতি প্রয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। আয়কর ফাইল যদি কোনো কারণে অডিটের জন্য নির্বাচিত হয়, সেই করদাতাকে ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, কিছু না কিছু কর ফাঁকি খুঁজে পেতে বের করবেনই কর কর্মকর্তা। এতে অনেক সময় ঘুষ লেনদেনের সুযোগ সৃষ্টি হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

আয়কর দাখিলপত্র অডিট নিয়ে বেশ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। কর কর্মকর্তা ছাড়াও কিছু পেশকার, কম্পিউটার অপারেটর, কিছু আয়কর আইনজীবী করদাতাদের ফাইল অডিটে পড়ার ভয়ও দেখান। সাধারণ আয়করদাতারা সহজেই এ ফাঁদে পা দেন। ‘অডিট নির্দেশনা’ নামে আয়কর বিভাগের একটি আদেশ আছে। সেখানে ‘ঝুঁকিপূর্ণ দাখিলপত্র’ কেমন হবে, সেটি নির্দিষ্ট করা থাকে। অভিযোগ রয়েছে, সেই নির্দেশনা এত ব্যাপক ও বিস্তৃত, কোনো করদাতাই বাইরে থাকেন না, সবাই অডিটের যোগ্য।

অডিটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, একজন করদাতার পিছনে সাতজন অফিসারকে ছুটতে হয়। কর্মকর্তা বদলি হলে ঝামেলা আরো বাড়ে। মূলত আয়কর আইনে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্যাবলী সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা উল্লেখ করা হয়েছে তা অত্যন্ত জটিল এবং বিদ্যমান কাঠামোয় তা অনুসরণ করা প্রায় অসম্ভব। অর্গানোগ্রামে একটি সার্কেল অফিসে মাত্র একজন করপরিদর্শক অর্থাৎ একটি জেলায় যদি একটি অফিস হয় তাহলে করপরিদর্শকও একজন! জনবলের অত্যাধিক ঘাটতিও বড় বাধা। নিরীক্ষা টিম গঠিত হওয়ার পর কোনো টিম সদস্য বদলি হয়ে গেলে পরিদর্শন প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব হয় না। বুক কিপিংয়ের অনলাইন ডাটাবেজ না থাকায়ও সমস্যা তৈরি হয়। করদাতা অডিটে পড়লে তাকে কমপক্ষে তিনজন অফিসারের কাছে তিনবার আসতে হয়। এটা করদাতার জন্য ভোগান্তির।

আয়কর কর্মকর্তারা জানান, করফাঁকি বের করাই অডিটের মূল উদ্দেশ্য। অনলাইনে রিটার্ন দাখিল হলে সেসব করদাতার অডিট প্রসেস সহজ হয়।

কর অঞ্চল-১০ থেকে জানানো হয়, সব করদাতার জন্য একই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনার বিদ্যমান বিধান বাস্তবসম্মত নয়। বর্তমান আইনে রেভিনিউ জেনারেটিং পয়েন্ট অ্যাড্রেস হয়নি। কোম্পানি করদাতার ক্ষেত্রে শতভাগ অডিট প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে সেটির দরকার নেই। ছোট করদাতার ক্ষেত্রে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যা করদাতা এবং কর কর্মকর্তা উভয়ের জন্যই সময়সাপেক্ষ এবং বিব্রতকর। তাই সব কর মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত করার প্রয়োজন নেই।

কর অঞ্চল সিলেট জানিয়েছে, অডিট সংশ্লিষ্ট করদাতার কাছ থেকে আইনে উল্লেখিত দুই ধাপে তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করার বিষয়টি মাঠ পর্যায়ে নানাবিধ কারণে যথাযথভাবে পরিপালন করা যাচ্ছে না। তাই অনুসন্ধানকারী এবং অডিটকারী টিমের সদস্যদের এক ধাপেই সংশ্লিষ্ট করদাতার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করার সুযোগ করে দেয়া দারকার।

কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল জানিয়েছে, সব মামলার ক্ষেত্রে অডিট টিম মাঠ পর্যায়ে যাচাই করা বাস্তবসম্মত নয়। তাই অনুসন্ধানকারী টিমের দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অডিট টিমের অডিট রিপোর্ট প্রণয়ন করার বিদ্যমান অডিট প্রক্রিয়া আরো সহজ করা দরকার।

কর অঞ্চল-৬ জানিয়েছে, বিদ্যমান বিধানাবলী প্রয়োগযোগ্য না হওয়ায় মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান রিপোর্ট সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না এবং অনুসন্ধান টিমের কর্মকর্তাদের বদলিজনিত কারণে অনুসন্ধান রিপোর্ট যথাসময়ে পাওয়া যাচ্ছে না।

কর অঞ্চল-৮ জানিয়েছে, কর্মকর্তাদের নাম দিয়ে অনুসন্ধান টিম এবং অডিট টিম গঠন করা হলে টিমের সদস্যদের বদলিজনিত কারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তাই নাম উল্লেখ না করে দপ্তর ও পদবি অনুসারে টিম গঠনের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ করা যেতে পারে।

কর অঞ্চল বরিশাল থেকে জানানো হয়, মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কর্মকর্তার সংকট বিদ্যমান রয়েছে।

বৃহৎ করদাতা ইউনিট থেকে জানানো হয়, অডিট নির্বাচন সংক্রান্ত পত্র প্রাপ্তির প্রথম সাত দিনের মধ্যে কমিশনার কর্তৃক অনুসন্ধান টিম ও অডিট টিম সংক্রান্ত বিষয়ক আদেশ জারি করতে হয়, যা পরবর্তীতে সংশোধনের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রয়োজন।

কর অঞ্চল কুমিল্লা থেকে জানানো হয়, কর কমিশনার প্রয়োজন মোতাবেক অনুসন্ধান টিম এবং অডিট টিম পুনর্গঠন করতে না পারায় নানাবিধ সংকট তৈরি হচ্ছে। অডিট মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে।

কর অঞ্চল-১৩ থেকে মত দেয়া হয়, বর্তমান আইনে আয়কর অনুবিভাগের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনারদের অডিট টিমের সদস্য করার সুযোগ না থাকায় সংকট গভীর হয়েছে। এ বিধানের সংশোধনী আনা প্রয়োজন। ১৮২ ধারায় বর্ণিত বিধানাবলী সংস্কার বিষয়ে অডিট মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিদ্যমান আইনে থাকা সময়সীমা বাড়াতে কর অঞ্চল-২০ থেকে প্রস্তাব করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *