নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া ফাইল দৈবচয়নের ভিত্তিতে ভ্যাট অডিট করা হয়। এই প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এবার দৈবচয়নের মাধ্যমে ভ্যাট অডিট প্রক্রিয়া থেকে সরে আসতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর পরিবর্তে ফাইল নির্বাচনের ক্ষেত্রে অটোমেটেড পদ্ধতি কার্যকর করতে চায় সংস্থাটি।
এর ফলে দৈবচয়নের ভিত্তিতে অডিটের দিন শেষ হতে যাচ্ছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।জানা গেছে, এনবিআরের সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নানা ধরনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি নেওয়া হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের উদ্যোগও।
তবে আগামী দিনে ভ্যাট অডিটের ক্ষেত্রে অটোমেটেড পদ্ধতি কার্যকর করতে চান এনবিআর চেয়ারম্যান। সেই সঙ্গে যেসব অডিট কার্যক্রম চলমান, সেগুলো দুই মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ কমবে এবং ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির অবসান হবে।বর্তমানে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শ্রেণিবিন্যাস করা নেই।
ভ্যাট কর্মকর্তারা নিজেদের ইচ্ছামতো যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট অডিট করেন। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের অডিট একাধিক কমিশনারেট করে থাকে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট অডিট একাধিক কমিশনারেটের করার সুযোগ নেই। আবার একই প্রতিষ্ঠানকে বছরে একাধিকবার অডিট করা হয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাবসায়িক কার্যক্রম বছরে একবার নিরীক্ষা করা সমীচীন।
গত বৃহস্পতিবার ভ্যাট ও কাস্টমস অনুবিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত রাজস্ব সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান নিরীক্ষার ক্ষেত্রে অটোমেটিক পদ্ধতি প্রয়োগের জোরালো নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়া ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে যেসব নিরীক্ষা কার্যক্রম চলমান, তা আগামী দুই মাসের মধ্যে শেষ করতে বলেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সভায় উপস্থিত একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তাদের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নেই। এতে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে ভ্যাট হারাচ্ছে সরকার। রাজস্ব আদায় বাড়াতে যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করেনি তাদের রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
কর ফাঁকির বিবেচনায় সিস্টেমে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুতর অনিয়মগুলো দিয়ে সফটওয়্যারে ইনপুট দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। এর মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে পূর্ববর্তী ফাঁকির প্রামাণ্য আলামত, দাখিলপত্র পেশ না করা, পূর্ণাঙ্গ তথ্য না দেওয়া, অধিক রেয়াত গ্রহণ, ক্রয়-বিক্রয়ের তথ্য গোপন রাখা, চালানপত্রে অসত্য ঘোষণা, অঘোষিত বিকল্প কাঁচামাল ব্যবহার, মূল্য সংযোজনের হার অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, খাতগুলো ঠিকভাবে প্রদর্শন না করা, রপ্তানি ও স্থানীয় বাজারে যুগপৎ বিক্রি, তথ্য সংরক্ষণে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা, অসম্পূর্ণ দলিলপত্র, তথ্য দিতে অস্বীকৃতি-অনীহা বা দেরি, অস্বাভাবিক হারে রিফান্ড দাবি, কেন্দ্রীয়ভাবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান, অসচ্ছল প্রতিষ্ঠান, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলে নিরীক্ষায় অগ্রাধিকার পাবে।
এ ছাড়া আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও উৎপাদককে পণ্য সরবরাহের আগে সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটকে মূল্য ঘোষণা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এই ঘোষণায় পণ্যের বিক্রয়মূল্য কিভাবে নির্ধারিত হয়েছে, তা মূল্য ভিত্তিতে দেখানো হয়। মূল্য ভিত্তি পরিবর্তিত হলে নতুন করে মূল্য ঘোষণা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে বিভিন্ন কৌশলে মূল্য ঘোষণা দেয়। এই কৌশল প্রতিরোধ করে কাঙ্ক্ষিত ভ্যাট আদায়ের নির্দেশনা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
সফটওয়্যারে এসব বিষয় ইনপুট দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান এর আওতায় থাকবে, তাদের নিরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া ভ্যাট ফাঁকির উদ্দেশ্যে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালালেও তাদের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নেই। এসব প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন করাতে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
এ ছাড়া কাস্টমস ও ভ্যাট অনুবিভাগের সঙ্গে অনুষ্ঠিত রাজস্ব সভায় কাস্টমসের বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পণ্য আমদানিতে পণ্যমূল্য অবমূল্যায়ন, অতিমূল্যায়ন, পণ্যের বিবরণ, এইচএস কোড, ওজন পরিমাণ, গুণগত মান ইত্যাদি বিষয়ে মিথ্যা ঘোষণা, প্রতারণা এবং একই ধরনের পণ্যের একাধিক চালান প্রস্তুতকরণ। অন্যান্য অনিয়মের মধ্যে রয়েছে উচ্চ কর আরোপযোগ্য পণ্যগুলোর ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে কম এবং নিম্নহারে কর আরোপযোগ্য পণ্যের ইনভয়েসে প্রকৃত পরিমাণ/ওজনের চেয়ে বেশি দেখানো, রেয়াতসংক্রান্ত এসআরওর শর্ত অমান্য এবং আমদানিনীতি, পরিবেশনীতি, অন্য বিধি-বিধান ও নীতিমালার শর্ত/নির্দেশনা ভঙ্গ করে পণ্য আমদানি। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ জড়িত থাকে। এনবিআর চেয়ারম্যান এ ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন।
বর্তমানে বিভিন্ন ভ্যাট কমিশনারেটের হাতে অনেক অডিটের ফাইল জমা আছে। এনবিআর সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ৮৮১টি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই হাজার ৭৪৩টি এবং সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই হাজার ১১২টি ফাইল অডিটের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। যদিও পূর্ণাঙ্গ অডিট করা হয়েছে খুবই সামান্য।
এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কারের অংশ হিসেবে এরই মধ্যে শুল্ক ও ভ্যাট প্রশাসনের প্রথম সচিব ও দ্বিতীয় সচিবের পদ থেকে অ্যাডমিন ক্যাডারের দুই কর্মকর্তাকে সরিয়ে কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রথম সচিব হিসেবে আ আ ম আমীমুল ইহসান খান ও দ্বিতীয় সচিব হিসেবে মো. আহসান উল্লাহকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কাস্টমস ক্যাডারের অন্য কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, পেশাগত কাজে এই দুই কর্মকর্তাই মেধাবী ও যোগ্য। এই দুই কর্মকর্তা নিয়োগ পাওয়ায় তাঁদের দাবি পূরণ হয়েছে এবং ভোগান্তিমুক্ত পরিবেশ তৈরি হবে।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নিরীক্ষা কার্যক্রম ও ভ্যাট রেজিস্ট্রেশনের আওতার বাইরে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনার পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, যত বেশি ম্যানুয়ালি কাজ হয় তত বেশি দুর্নীতির সুযোগ থাকে। দেখা-সাক্ষাৎ হলেই ঘুষের সুযোগ হয়। ম্যানুয়ালি কাজ হলে অসৎ ব্যক্তিরাই সুবিধাভোগী হন, সৎ ব্যক্তিরা সুবিধাবঞ্চিত হন। অনিয়ম শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই করেন না, ব্যবসায়ীরাও করেন। কিন্তু অটোমেটিক হলে দুর্নীতি-অনিয়ম অনেক কমে আসবে। বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানের নেওয়া সব কার্যক্রমকেই খুব ইতিবাচক মনে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য আব্দুল মান্নান পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি করা গেলে খুবই ভালো হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট অডিট করতেই অনেক সময় লাগে, সব প্রতিষ্ঠানের অডিট করা যায় না। যদি অটোমেটেড সিস্টেম হয় তাহলে দ্রুত অনেক প্রতিষ্ঠানের অডিট করা যাবে। এতে রাজস্ব হারানোর ঝুঁকিও কমে যাবে এবং আদায়ের পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
সূত্র:কালের কণ্ঠ
অনেক ভ্যাট অফিস বা সার্কলের ভ্যাট অফিসারগন নিজেই অনেক প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট এর কাজ করে দেয়, যেমন ৯.১ বা রির্টান দেওয়া, ভ্যাটের ডকুমেন্টেশন ইত্যাদি। যার ফলে ভ্যাট অফিসারগন ওই ফাইলের ভ্যাটের পরিমান নিয়ে কিংবা কনসারন/Concern থাকেন না। তাদের একমাত্র কনসারন/Concern থাকে কিভাবে ক্লাইন্ট থেকে কত টাকা নগদ পাওয়া যায়। ক্লাইন্ট টাকা বেশি দিলে ওই ফাইল খুলেও দেখে না। যার ফলে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। তাছাড়া বিআইএন থাকা স্বত্বেও প্রতিষ্ঠান রির্টান জমা দিচ্ছে না, যা রাজস্ব আহরণে প্রভাব ফেলেছে।