সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে!

সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে।

সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয়া হয়েছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে। সেই আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়ে এজেন্ট প্রতিনিধি প্রবেশ করলেন অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে। তাতে আপলোড করলেন নিজেদের (সিঅ্যান্ডএফ) তৈরি করা রিপোর্ট। যার মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বের করতে চাইলেন নয় কনটেইনার পণ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়নি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এমন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। আরাগ ট্রেডিং কোং লিমিটেড নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি মো. বজলুর রহমান নামে একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে পরীক্ষণ রিপোর্ট আপলোড করেছেন।

তবে, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জালিয়াতির বিষয়টি অস্বীকার করেছে। আর কর্মকর্তা বলছে, তিনি কোনো পরীক্ষণ রিপোর্ট আপলোড করেননি। নিজের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড সুরক্ষা দিতে না পারায় ওই কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা বলছে, ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ডের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এনবিআর থেকে বার বার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কাস্টম হাউস ও কর্মকর্তারা তা কঠোরভাবে পালন করছেন না। যার ফলে জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। কঠোর না হলে জালিয়াতি রোধ সম্ভব হবে না।

এনবিআর সূত্রমতে, ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড জালিয়াতির ঘটনা যাচাই করে আরাগ ট্রেডিং ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনারকে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। গতকাল বুধবার কাস্টমস গোয়েন্দার উপপরিচালক মোছা. আয়শা সিদ্দিকার সই করা এই চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আরাগ ট্রেডিং কোং লিমিটেড পণ্য খালাসের জন্য ১৭ ডিসেম্বর একটি বিল অব এন্ট্রি দাখিল করেন (বিল অব এন্ট্রি-১৯৭৭৩৯০)। গোপন সংবাদ থাকায় চালানটির ওপর নজরদারি করে কাস্টমস গোয়েন্দা। ১৯ ডিসেম্বর অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে দেখা যায় যে, চালানটির কায়িক পরীক্ষণ রিপোর্ট দেয়া হয়েছে (আপলোড করা হয়েছে)। রিপোর্ট প্রদান করেছেন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. বজলুর রহমান। কাস্টমস গোয়েন্দার পক্ষ থেকে বজুলর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, এই রিপোর্ট বিষয়ে তিনি অবগত নন। এই বিল অব এন্ট্রির চালানের পণ্য পরীক্ষণ ও রিপোর্ট তিনি দেননি। অর্থাৎ তিনি অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে রিপোর্ট আপলোড করেননি। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, স্বল্প সময়ের জন্য তিনি সহকারী কমিশনার সোমেন কান্তি চাকমার রুমে গিয়েছেন। তার অনুপস্থিতিতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আরাগ ট্রেডিংয়ের জেটি সরকার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ইন্সপেকশন অ্যাক্ট-এ রিপোর্ট প্রদান করে থাকতে পারে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, ইন্সপেকশন অ্যাক্টে কায়িক পরীক্ষায় এক দশমিক শূন্য তিন শতাংশ অতিরিক্ত পণ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু কাস্টমস গোয়েন্দার কায়িক পরীক্ষায় ঘোষণাবর্হিভূত পণ্যসহ ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য পাওয়া গেছে। তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও জেটি সরকারের বিরুদ্ধে কাস্টমস এজেন্টস লাইসেন্সিং বিধিমালা, ২০২০ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে অ্যাসাইকুডা

ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে নিজস্ব আইডি ও পাসওয়ার্ডের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পরীক্ষণ কর্মকর্তা মো. বজলুর রহমানকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রাখার জন্য এনবিআর সময়ে সময়ে জারি করা আদেশ অনুসরণপূর্বক যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য কাস্টম হাউসের সবাইকে নির্দেশনা প্রদানের জন্য চিঠিতে অনুরোধ করা হয়।

এই বিষয়ে সহকারী কমিশনার সোমেন কান্তি চাকমা শেয়ার বিজকে বলেন, কায়িক পরীক্ষার সময় আমি ছিলাম না। কায়িক পরীক্ষার জন্য সাধারণত আমরা কর্মকর্তা পোস্টিং দেয়। কোনো পণ্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে, সে কায়িক পরীক্ষার সময় আমরা থাকি। এই চালানে টাইলস দেখে টাইলসকে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করিনি, সেজন্য আমি ছিলাম না। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে দিয়েছে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করলে ওটিপি যায়। আর সেটা এক বা দুই মিনিট থাকে। ব্যবহার না করলে অটো লক হয়ে যায়। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা তো একেকবার একেক কথা বলে। একবার বলে জেটি সরকারকে নিজেই দিয়েছে। বিশ্বাস করে দিতেই পারেন। আবার বলে নিজেই অনলাইনে রিপোর্ট দিয়েছে। ওই কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। আরাগকে শোকজ করা হতে পারে।

কর্মকর্তার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে জালিয়াতির অভিযোগ বিষয় অস্বীকার করেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আরাগ ট্রেডিং কোং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন চৌধুরী। হেলেনা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (প্রাইভেট) লিমিটেড নামে তাদের আরও একটি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইসেন্স রয়েছে। তিনি সহকারী রাজস্ব মো. বজলুর রহমানকে ‘পাগল’ বলে  আখ্যায়িত করেন তিনি। বলেন, ‘আমরা কখনও এই ধরনের কাজ করেছি কি না; তা খবর নেন। অফিসার বদ্ধ পাগল। তিনি কায়িক পরীক্ষা করেছেন, রিপোর্ট দিয়েছেন, সই করেছেন-বলছে মাল দেখেননি। উনার পাসওয়ার্ড ব্যবহার করব, আমার কাজ কী? আমি কি কাস্টমস অফিসার? আমার কি ঠেকা পড়েছে যে ইম্পোর্টারের প্রফিটের জন্য আমার জীবন দেবো?’ কর্মকর্তা সহকারী কমিশনারের রুমে যাওয়ার সময় কম্পিউটার খোলা ছিল। আপনাদের প্রতিনিধি রিপোর্ট লোড করেছেÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেখানে বাপ্পি নামে আমাদের একজন স্টাফ ছিল। তবে সে আপলোড করেনি।’

টাইলস ছাড়া ঘোষণা-বর্হিভূত পণ্য পাওয়া গেছে-গিফট বক্স পাওয়া গেছে-এ বিষয়ে নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘গিফট বলতে ১০০ গ্রাম বাচ্চার জন্য দিয়েছে। প্রায় দেড় কোটি টাকা শুল্ককর দেবো। এতে ১০০ গ্রাম মাল কাউন্টে পড়ে? টাইলস ছাড়া আর কোনো পণ্যই ছিল না। চট্টগ্রাম বন্দর এখন আগের বন্দর নেই। এখান থেকে এখন একটা সুঁইও সরাতে পারবেন না। কাস্টমস গোয়েন্দা ঘোষণা অতিরিক্ত ও ঘোষণাবর্হিভূত যে পণ্যের কথা বলেছে তা সঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ঢাকার সিরামিক গ্যালারি এই ৯ কনটেইনার পণ্য আমদানি করেছে। আমরা তাদের কাজ করি। কোনো দিন বেশি কম পায়নি। তাদের আরও ১৬ কনটেইনার টাইলস বন্দরে রয়েছে। কাস্টমসকে এই পণ্য দেখতে বলেন। টাইলস ভঙ্গুর মাল। ৩-৪ শতাংশ ভেঙে যায়। এনবিআরের অর্ডারেও রয়েছে।

অপরদিকে, এই বিষয়ে যোগাযোগ করেও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বজলুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি কাস্টমস গোয়েন্দায় একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে বলেছেন, তিনি চট্টগ্রামে জেটি কাস্টমসে কর্মরত রয়েছেন। ১৮ ডিসেম্বর সহকারী কমিশনার সোমেন কান্তি চাকমা আরাগ ট্রেডিংয়ের চালানটি পরীক্ষণের জন্য প্রদান করেন। ১৯ ডিসেম্বর চালানটি সম্পর্কে কাস্টমস গোয়েন্দা টাইলস চালানটির পরীক্ষণ ও সিস্টেমে রিপোর্ট দিয়েছেন কি না, জিজ্ঞাসা করুন। কিন্তু এই রিপোর্ট সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। অথচ আমার আইডি ও পাসওয়ার্ড থেকে রিপোর্ট জমা হয়েছে দেখে আমি হতবাক। পরে আমি জানতে পারি, আমি সোমেন কান্তি চাকমার কাছে গেলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের জেটি সরকার আমার ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে রিপোর্ট প্রদান করেছে। আমি বয়স্ক মানুষ, স্মৃতিশক্তি তেমন প্রখর না। ব্যস্ততার মধ্যে হয়তো রিপোর্টের হার্ড কপিতে সই করেছি। প্রকৃত সত্য হলো, আমি এই বিল অব এন্ট্রির পণ্যগুলো দেখিনি।

কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্রমতে, সিরামিক গ্যালারি নামে ঢাকার আমদানিকারক চীন থেকে নয় কনটেইনার টাইলস আমদানি করে। চালানটিতে টাইলস ছাড়াও অন্য একাধিক পণ্য থাকতে পারে। সেই পণ্য সরিয়ে ফেলতে পারেন। রহস্যজনকভাবে জেটি কাস্টমসের সহকারী কমিশনার কায়িক পরীক্ষার সময় উপস্থিত ছিলেন না। যে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে পরীক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তিনি পণ্য দেখেননি। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মূল সিল খুলেছেন। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যে সময় কায়িক পরীক্ষা করেছে, সে সময় টাইলস ছাড়াও ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য পেয়েছে। যেমন গিফট বক্স পাওয়া গেছে, যাতে রয়েছে মেয়েদের চুলের ক্লিপ, ব্র্যান্ড। এছাড়া মাত্র এক দশমিক শূন্য তিন শতাংশ অতিরিক্ত পণ্য পাওয়া গেছে বলা হলেও কাস্টমস গোয়েন্দা পেয়েছে চার দশমিক ৬১ শতাংশের বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু সহকারী কমিশনার উপস্থিত ছিলেন না, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাও ঠিক মতো দেখেননি, সেহেতু আরও বেশ কিছু ঘোষণাবহির্ভূত ও ঘোষণা অতিরিক্ত পণ্য থাকতে পারে। কারণ, কাস্টমস গোয়েন্দা অনেক পরে কায়িক পরীক্ষা করেছে।

এই বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দার একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড সুরক্ষা এবং গোপনীয়তা রক্ষার জন্য এনবিআর সময়ে সময়ে নির্দেশনা জারি করেছে, যা মানা হচ্ছে না। বিষয়টি কাস্টম হাউস, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে মেনে চলা উচিত। তিনি বলেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট তো সব সময় সুযোগ খুঁজবে। কিন্তু কর্মকর্তাকে তার আইডি, পাসওয়ার্ডের গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। ওই সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বয়স্ক, কম্পিউটারে দক্ষ নয়। যার সুযোগ নিয়েছে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। কাস্টমস হাউসে ব্যস্ততা থাকবে, কিন্তু কর্মকর্তাকে সর্তক হতে হবে। কাস্টমস হাউসকে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে জালিয়াতি বন্ধ হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *