ই-ফাইলিং বাধ্যতামূলক হলে বাড়তি কর আসবে ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। ১ কোটি ৩৫ লাখ লোক কর দিতে সক্ষম হলেও রিটার্ন দিয়েছে ৪১ লাখ ৪৫ হাজার। আগামী অর্থবছরেই করপোরেট ট্যাক্স অনলাইনে নিয়ে আসতে চাই। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় বাড়াতে ক্রেতা ইনভয়েস নিলে ক্যাশব্যাক পাবেন– এমন পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে কর আদায়-সংক্রান্ত লেনদেন বাধ্যতামূলক করা হলে প্রতিবছর অন্তত ২ হাজার ৪১০ কোটি ডলার বা প্রায় ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আহরণ সম্ভব বলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে এনবিআরের কাস্টমস, ভ্যাট, ট্যাক্স ও পেমেন্টে কিছু ডিজিটালাইজেশন হলেও তাদের সমন্বয় না থাকায় তা তেমন কাজে আসছে না। এনবিআরের নিজস্ব বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করেই কর ফাঁকি ঠেকাতে হবে।
গতকাল রোববার রাজধানীর লেকশোর হোটেলে অনুষ্ঠিত এক সংলাপে ‘রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিতে প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের কর ব্যবস্থার আধুনিকায়ন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় চলমান জনসম্পৃক্ত সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের আর্থিক সহায়তায় এ গবেষণা কার্যক্রম চালানো হয়।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পুরোটাই ঋণনির্ভর। দীর্ঘদিন এ অবস্থা অব্যাহত থাকায় ঋণের বোঝা বেড়ে গেছে। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সরকারকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণসহ বিভিন্ন কারণে বিদেশি অনুদান কমে গেছে। একই সঙ্গে কঠিন শর্তে ঋণ নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আগামীতে রাজস্ব বাড়াতে না পারলে দেশ বিপজ্জনক ও বাধ্যতামূলকভাবে পরনির্ভরশীলতার দিকে ধাবিত হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিভিন্ন বিভাগ বিক্ষিপ্তভাবে কিছু অনলাইন কার্যক্রম চালু করেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা না থাকা এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সিপিডি ২০২২ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, দেশব্যাপী ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে কর আদায়-সংক্রান্ত লেনদেন বাধ্যতামূলক করা হলে প্রথম বছরই বাড়তি ২ হাজার ৪১০ কোটি ডলার রাজস্ব আহরণ সম্ভব। এর পরবর্তী বছরগুলোতে তা আরও বেড়ে ৩ হাজার ২৬০ কোটি ডলারে উন্নীত হওয়া সম্ভব।তিনি আরও বলেন, সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২০ সালেই কর-জিডিপির অনুপাত সাড়ে ১৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা ৮ শতাংশের নিচে। তার পরও এখন থেকে যদি পুরো কর কার্যক্রমকে প্রযুক্তির মাধ্যমে অটোমেশন করার পাশাপাশি অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক সংস্থার সঙ্গে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করে রাজস্ব আহরণ করা হয়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে কর-জিডিপির অনুপাত ১৬ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব।
সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগের কারণে কিছু ক্ষেত্রে করদাতার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। তার পরও তারা পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, দেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে অন্তত ১ কোটি ৩৫ লাখ ১৯ হাজার ৭০০ জন কর দিতে সক্ষম। এর মধ্যে টিআইএনধারী প্রায় ১ কোটি। কিন্তু গত অর্থবছর মোট ৩৫ লাখ ২৯ হাজার জন আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৪১ লাখ ৪৫ হাজার জন আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। অর্থবছর শেষে হয়তো কিছুটা বাড়বে।তিনি জানান, কর দিতে সক্ষম এমন সবাইকে করের আওতায় আনতে এনবিআর কাজ করছে। কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে জনগণকেও কর দিতে উৎসাহিত হতে হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বাজেটে যখন রাজস্ব আদায়ের টার্গেট দেওয়া হয়, তখন অসহায় থাকে এনবিআর। মন্ত্রণালয় আগের বছরের অর্জন হিসাবে না এনে কেবল আগের লক্ষ্যমাত্রার ওপর ভিত্তি করে পরের বছরে নতুন টার্গেট বাড়িয়ে দেয়। ফলে কিছু অন্য উদ্ভাবনী পরিকল্পনা বা চিন্তার সুযোগ থাকে না। তারপরও করদাতাদের চাপ না দিয়ে আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়ানো হয়। দেশে উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন না বাড়লে রাজস্ব বাড়বে না। এ জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।
আগামীর পরিকল্পনা জানিয়ে তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের পরিকল্পনা এনবিআরের রয়েছে। আগামী অর্থবছরেই করপোরেট ট্যাক্স অনলাইনে নিয়ে আসতে চাই। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় বাড়াতে ক্রেতা ইনভয়েস নিলে ক্যাশব্যাক পাবেন– এমন পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি ব্যয় স্বচ্ছ ও গুণগত মানসম্পন্ন না হলে জনগণ কর দিতে উৎসাহী হন না। কর থেকে আয় করা অর্থ ব্যয় ডিজিটাল হতে হবে, যাতে মানুষের সংশ্রব থাকবে না। এতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, যারা ট্যাক্স দেয় না, অথচ দেশ থেকে টাকা পাচার করে, তারা অনেক শক্তিশালী। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি না থাকলে অসহায় এনবিআর ঝুঁকির মধ্যে থাকবে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, এনবিআরের প্রশাসনিক সংস্কার করতে হবে। ১৯৯০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগই আধুনিকায়নের জন্য। অথচ ধারাবাহিকতা রক্ষা না করায় কাজে আসেনি।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, অর্থ বিভাগের সাবেক সচিব মুসলিম চৌধুরী, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন, সাবেক সদস্য আলমগীর হোসেন, বিজিএমইএর পরিচালক শামস মাহমুদসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি বক্তব্য দেন।